ডিপসিক: চীনের নতুন এআই মডেলের উত্থানে বিশ্ব বাজারে তোলপাড়

Tech News

ভূমিকা
বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি খাত বর্তমানে এক গভীর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। চীনের স্টার্টআপ কোম্পানি ডিপসিকের তৈরি স্বল্পখরচের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেল এই অস্থিরতার মূল কারণ। ডিপসিকের এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট “ডিপসিক” চ্যাটজিপিটির মতো প্রতিষ্ঠিত প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এর প্রভাবে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে, যা এনভিডিয়া, মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেটের মতো শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বাজারমূল্য হ্রাসের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এই প্রতিযোগিতা ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি নেতৃত্বের লড়াইকে তীব্র করবে।

শেয়ারবাজারে ধসের প্রেক্ষাপট
গত সপ্তাহে ডিপসিকের এআই অ্যাসিস্ট্যান্টের উন্মোচনের পর থেকে বৈশ্বিক প্রযুক্তি শেয়ারবাজারে ব্যাপক ধস নেমেছে। বিশেষ করে, এআই এবং সেমিকন্ডাক্টর খাতের কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নাসডাক সূচক ৩.১% হ্রাস পেয়েছে, যা ২০২৩ সালের পর একদিনের সবচেয়ে বড় পতন। এনভিডিয়ার শেয়ার মূল্য ১৭% কমে যায়, যার ফলে কোম্পানিটির বাজারমূল্য ৫৯৩ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পায়। এটি ওয়াল স্ট্রিটের ইতিহাসে একদিনে কোনো কোম্পানির সর্বোচ্চ ক্ষতির রেকর্ড। এছাড়া ব্রডকম (১৭.৪%), মাইক্রোসফট (২.১%), এবং অ্যালফাবেট (৪.২%)-এর শেয়ারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

ফিলাডেলফিয়া সেমিকন্ডাক্টর ইনডেক্স ৯.২% নিচে নেমে ২০২০ সালের মার্চের পর সবচেয়ে বড় পতন রেকর্ড করে। এই ইনডেক্সের অন্তর্গত মার্ভেল টেকনোলজির শেয়ার ১৯.১% হ্রাস পায়। এশিয়ার বাজারে জাপানের সফটব্যাংক গ্রুপ ৮.৩% এবং ইউরোপে এএসএমএল ৭% মূল্য হারায়। বিশ্লেষকদের মতে, ডিপসিকের সাফল্য এআই খাতের ভবিষ্যৎ লাভজনকতা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সংশয় সৃষ্টি করেছে, যা শেয়ারবাজারের এই ধসের জন্য দায়ী।

ডিপসিকের প্রযুক্তিগত সাফল্য ও উদ্ভাবন
ডিপসিকের প্রধান আকর্ষণ হলো এর স্বল্প ব্যয় এবং উচ্চ দক্ষতা। প্রচলিত এআই মডেলগুলোর তুলনায় এটি কম ডেটা ব্যবহার করে দ্রুত ও সঠিক সেবা প্রদান করতে সক্ষম। এর পেছনে রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং-এর অভিনব কৌশল। তিনি এনভিডিয়ার এ-১০০ চিপের একটি বড় মজুদ সংগ্রহ করেছিলেন, যা বর্তমানে চীনে রপ্তানি নিষিদ্ধ। প্রায় ৫০,০০০ চিপের সমন্বয়ে ডিপসিকের অবকাঠামো গঠিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়েনফেং সস্তা চিপের সাথে এ-১০০ চিপের সমন্বয় করে একটি শক্তিশালী কম্পিউটিং নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন, যা ডিপসিকের দক্ষতার মূল চাবিকাঠি।

অ্যাপের জনপ্রিয়তা ও ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়া
ডিপসিকের অ্যাপটি ১০ জানুয়ারি, ২০২৪-এ যুক্তরাষ্ট্রে উন্মুক্ত করা হয়। অ্যাপল অ্যাপ স্টোর এবং কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায় এই অ্যাপ। মুক্তির পরপরই এটি অ্যাপ স্টোরের শীর্ষ ডাউনলোড তালিকায় চ্যাটজিপিটিকে পিছনে ফেলে। ব্যবহারকারীদের মতে, ডিপসিকের ইন্টারফেস ব্যবহারবান্ধব এবং এটি দৈনন্দিন কাজে দ্রুত সমাধান দেয়। তবে কিছু ব্যবহারকারী সাইন-আপ প্রক্রিয়ায় জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন
অ্যানেক্স ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ ব্রায়ান জ্যাকবসেন বলেন, “ডিপসিক যদি সত্যিই একটি উন্নত মডেল হয়, তবে এটি গত দুই বছরের এআই-কেন্দ্রিক বাজারকে আমূল বদলে দিতে পারে।” তাঁর মতে, ডিপসিকের সাফল্য এআই শিল্পে প্রতিযোগিতার মাত্রা বাড়াবে, যার ফলে চিপ উৎপাদন, ডেটা সেন্টার নির্মাণ, এবং বিদ্যুৎ খাতের চাহিদা কমতে পারে। এই পরিবর্তন শুধু প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে নয়, রাষ্ট্রীয় নীতিকেও প্রভাবিত করবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া
মার্কিন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ডিপসিকের উত্থানকে “মার্কিন শিল্পের জন্য একটি জাগরণ” বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “এই প্রতিযোগিতা মার্কিন কোম্পানিগুলোকে আরও উদ্ভাবনী ও কম খরচে প্রযুক্তি উন্নয়নে বাধ্য করবে।” তবে তিনি চীনের সাথে প্রযুক্তি লড়াইয়ে জেতার জন্য মার্কিন নীতিগত সমর্থন বাড়ানোরও আহ্বান জানান।

ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা ও পথচলা
৪০ বছর বয়সী লিয়াং ওয়েনফেং একজন তথ্য প্রযুক্তি প্রকৌশলী। তিনি হাংঝৌ শহরে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ডিপসিক প্রতিষ্ঠা করেন। হেজ ফান্ড থেকে প্রাথমিক অর্থায়ন পাওয়া এই স্টার্টআপটি অল্প সময়েই চীনের এআই খাতে আলোড়ন তোলে। ওয়েনফেং-এর পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং এনভিডিয়ার চিপ সংগ্রহ করার দক্ষতা ডিপসিকের প্রযুক্তিগত ভিত্তি মজবুত করেছে।

প্রযুক্তি খাতের ভবিষ্যৎ ও সম্ভাব্য প্রভাব
ডিপসিকের সাফল্য এআই শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি শুধু একটি অ্যাপ নয়, বরং একটি অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শিফটের ইঙ্গিত দেয়। যদি ডিপসিকের মডেলটি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয়, তবে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলি ঘটতে পারে:

১. খরচ হ্রাস: এআই পরিষেবাগুলো সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে, যা中小型企业গুলোর জন্য সহজলভ্য হবে।
২. প্রতিযোগিতার তীব্রতা: গুগল, মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানিগুলোকে তাদের মডেলের দাম ও দক্ষতা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করবে।
৩. সেমিকন্ডাক্টর চাহিদা হ্রাস: ডিপসিকের কম চিপনির্ভর মডেল সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
৪. ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব: চীন-মার্কিন প্রযুক্তি যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করে ডিপসিকের সাফল্য রাষ্ট্রীয় নীতিকে প্রভাবিত করবে।

উপসংহার
ডিপসিকের উত্থান বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করেছে। এর প্রভাবে শেয়ারবাজারে ধস, কোম্পানিগুলোর কৌশল পুনর্বিন্যাস, এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও ডিপসিক এখনও তার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এর সম্ভাব্যতা ইতিমধ্যেই শিল্প বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলেছে। ভবিষ্যতে এই প্রতিযোগিতা প্রযুক্তির গতি, মূল্য, এবং প্রাপ্যতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায়, “এই ঝড় আমাদের জাগ্রত করেছে—এবার দেখার বিষয়, কে এগিয়ে থাকবে।”

COMPUTER TIPS & TRICKS
Google Tutorial
MOBILE TUTORIAL